“বাজারজাতকরণ হচ্ছে মুনাফাযোগ্য ক্রেতা সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা করা” (Marketing is managing profitable customer relationships). বিভিন্ন বাজারজাতকরণ বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বাজারজাতকরণকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বাজারজাতকরণের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায়।
১. সামাজিক প্রক্রিয়া (Social process) : সমাজে বসবাসরত মানুষের প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদা পরিতৃপ্তির লক্ষ্যে বাজারজাতকরণ কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। এজন্য Philip Kotler এবং Gary Armstrong বাজারজাতকরণকে সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
২. ব্যবস্থাপকীয় প্রক্রিয়া (Managerial process) : বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে পরিকল্পনা, সংগঠন, প্রেষণা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। তাই তো Philip Kotler ও Gary Armstrong বাজারজাতকরণকে ব্যবস্থাপকীয় প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৩. অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া (Economic process) : বাজারজাতকরণ পরিবহনের মাধ্যমে স্থানগত, গুদামজাতকরণের মাধ্যমে সময়গত এবং ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে স্বত্বগত উপযোগ সৃষ্টি করে। এজন্যই P. D. Converse বলেছেন, “Marketing includes all the activities involved in the creation of place, time and procession utilities.”
৪. বিনিময় প্রক্রিয়া (Exchange process) : বিনিময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোক্তার প্রয়োজন ও অভাবের সন্তুষ্টি বিধান করা হয়। Philip Kotler ও Gary Armstrong এর ভাষায়, “Exchange is the act of obtaining a desired object from someone by offering something in return.”
৫. গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic process) : প্রতিনিয়ত বাজারজাতকরণ পরিবেশ, প্রতিযোগিতা, ভোক্তাদের রুচি, পছন্দ, চাহিদা, জীবনমান পরিবর্তিত হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনে বাজারজাতকরণ কৌশলে পরিবর্তন আসছে। তাই তো বাজারজাতকরণ একটি গতিশীল প্রক্রিয়া।
৬. সন্তুষ্টি বিধানের প্রক্রিয়া (Process of satisfying) : দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে ভোক্তার সন্তুষ্টি আধুনিক বাজারজাতকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ একজন সন্তুষ্ট ক্রেতা শুধু নিজেই পণ্য কিনে না, অন্যকেও পণ্য কিনতে উৎসাহিত করে। এজন্য Philip Kotler ও Gary Armstrongসহ আধুনিক লেখকগণ বাজারজাতকরণকে সন্তুষ্টি বিধানের প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৭. উদ্দেশ্য অর্জন প্রক্রিয়া (Process of achieving) : ব্যক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে পণ্য বা সেবা গ্রহণের মাধ্যমে সর্বাধিক সন্তুষ্টি লাভ করা। বাজারজাতকরণ সেই লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যায়। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোক্তা সন্তুষ্টির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা।
৮. সমন্বয়সাধন প্রক্রিয়া (Co-ordination process) : বাজারজাতকরণ ভোক্তাদের প্রয়োজন, রুচি, পছন্দ, ক্রয়ক্ষমতা প্রভৃতির সাথে পণ্যের সমন্বয়সাধন করে। যেমন- দরিদ্র মানুষের কথা মাথায় রেখে ২ টাকা মূল্য মানের শ্যাম্পু, ৪-৬ টাকা মূল্য মানের নারকেল তেল প্রভৃতি বাজারজাতকরণ করা হচ্ছে। আবার বাজারজাতকরণ উদ্বৃত্ত অঞ্চলের পণ্য ঘাটতি অঞ্চলে প্রেরণ করে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে।
৯. ভোক্তামুখিতা (Consumer orientation) : ‘Consumer is the king’ এ বক্তব্যকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে রাজারজাতকরণের সকল কার্যক্রম ভোক্তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। ভোক্তাদের প্রয়োজন, অভাব ও চাহিদা চিহ্নিত করে তা যথাযথভাবে পূরণের চেষ্টা চালানো হয়।
১০. বাজারজাতকরণ প্রয়োগমুখী (Marketing is operational) : পুঁথিগত আলোচনার চেয়ে বাস্তবে বাজারজাতকরণের ব্যবহার অনেক বেশি। প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যই বাজারজাতকরণ নীতি ও কৌশল বাস্তবে প্রয়োগ করে থাকে।
১১. ব্যাপক আওতা (Wider scope) : আধুনিক যুগে বাজারজাতকরণ শুধু পণ্য ও সেবা নিয়েই কাজ করে না। বর্তমান বাজারজাতকরণ হচ্ছে ১০টি সত্তার সমন্বিত রূপ। এগুলো হচ্ছে- পণ্য, সেবা, অভিজ্ঞতা, ইভেন্টস, ব্যক্তি, স্থান, সম্পত্তি, সংগঠন, তথ্য এবং ধারণা।
১২. মধ্যস্থকারবারিদের অস্তিত্ব (Existence of middlemen) : বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে মধ্যস্থকারবারির অস্তিত্ব বিদ্যমান। যেমন- পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী, ডিলার, এজেন্ট প্রমুখ।
১৩. কার্যাবলির সমষ্টি (Aggregation of functions) : বাজারজাতকরণ অনেক কাজের সমষ্টি যার সাহায্যে পণ্য, সেবা, ধারণা সঠিক সময়ে, সঠিক স্থানে, সঠিক ভোক্তার কাছে পৌঁছানো যায়। যেমন- ক্রয়, বিক্রয়, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, অর্থসংস্থান, প্রমিতকরণ, পর্যায়িতকরণ, ঝুঁকিগ্রহণ, নীতি নির্ধারণ, তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ, প্রসারমূলক কার্যক্রম, প্যাকেজিং, তথ্যসংগ্রহ, বিক্রয়োত্তর সেবা প্রভৃতি।
১৪. প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রম (Competitive activity) : Survival is the fittest’ এ দর্শনে প্রতিষ্ঠান অনুপ্রাণিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিযোগিতায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। এজন্য সর্বোচ্চ ভ্যালু নির্ভর ক্রয়ক্ষমতা সম্পন্ন পণ্য মূল্য, বিচিত্র পণ্যসম্ভার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। যার সুফল ভোক্তার জীবনযাপনে প্রবাহিত হচ্ছে।
১৫. সামাজিক বাজারজাতকরণ (Social marketing) : বাজারজাতকরণ সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। সেজন্য সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ও বাজারজাতকরণের অন্তর্ভুক্ত। যেমন- মাদক মুক্ত জীবন, গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান, আপনার শিশুকে টিকা দিন, আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান, আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করুন প্রভৃতি বিষয়ে শ্লোগান ও কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বর্তমানে জনসচেতনতা সৃষ্টি করেছে।